স্বদেশ ডেস্ক:
এক এক করে সরকারের তৃতীয় বছর পার হতে চলল। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে সরকারের যাত্রা শুরু হয়। তবে সরকার সব প্রতিবন্ধকতা ভালোভাবেই উতরিয়েছে। সরকারের সামনের দুই বছরে আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। সরকারও পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কর্মপন্থা তৈরি করছে এমনটি জানান সংশ্লিষ্টরা। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সামনের দিনগুলোয় সরকারকে একগুচ্ছ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
এর মধ্যে রয়েছে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা, মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ সরকারের বাকি মেয়াদে শেষ করা, দুর্নীতি নির্মূল, বিদেশে অর্থপাচার ঠেকানো ও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন। এ ছাড়াও সরকারকে কুমিল্লার পূজামণ্ডপে কোরআন অবমাননার অভিযোগে সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে চলমান সহিংস ঘটনা নিয়ন্ত্রণ, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অস্থিরতা প্রশমন ও তাদের অপরাধমূলক কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখা এবং নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্য মানুষের নাগালে আনাও বড় চ্যালেঞ্জ। এ পরিস্থিতির মধ্যে আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকারকে নির্বাচনমুখীও হতে হচ্ছে। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। বিতর্কমুক্ত নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
এই কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নেরও দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে; যদিও সরকারের একাধিক মন্ত্রী বলেছেন, সার্চ কমিটির মাধ্যমেই ইসি গঠন করা হবে। এসবের বাইরেও সরকারকে আরও কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে ২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশজুড়ে শুরু হওয়া করোনা ভাইরাসের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে রাখা। যদিও বর্তমানে এই ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে সামনের দিনগুলোয় করোনার আরেকটি ধাক্কা এলে তা সামাল দেওয়া কঠিন হবে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সে জন্য সরকারকে এখন থেকেই সব ধরনের প্রস্তুতি রাখতে হবে।
করোনা ভাইরাসের কারণে দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এত লোকের কর্মসংস্থান নিয়েও সরকারকে ভাবতে হচ্ছে। নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভর্তুকি মূল্যে টিসিবির মাধ্যমে নিত্যপণ্য মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষের পাশে থাকাটাও সরকারের চ্যালেঞ্জ। বৈশ্বিক করোনা ভাইরাসের কারণে বিদেশে কর্মরত বিপুলসংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। তাদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বিদেশে সংকুচিত হয়ে আসা চাকরির বাজার সম্প্রসারণের দিকে মনোযোগ দেওয়ার কাজটিও সরকারকে করতে হবে। তা না করা হলে সার্বিক রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপর বড় ধাক্কা লাগতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এ ছাড়া প্রবাসীকর্মীদের দেশে ফিরে আসা অব্যাহত থাকলে অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারে আরও চাপ বাড়াবে তারা। বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে স্বাস্থ্য খাতও । এ দিকটাও নজর দিতে হবে সরকারকে।
সরকারের সামনে দাঁড়ানো এসব চ্যালেঞ্জের বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান আমাদের সময়কে বলেছেন, ভোটারদের ভয় পাইলেও গণতন্ত্র থাকে না। এ জন্য নির্বাচনে যে ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তার কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তা দেখা দরকার। এ ছাড়া সরকারের উন্নয়নের জোয়ারে নিজের এলাকায় সেই উন্নয়নের ছোঁয়া কতটা লেগেছে তা দেখতে হবে। আমাদের চ্যালেঞ্জের মধ্যে রোহিঙ্গা সমস্যা অন্যতম। এটি দেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করছে। আমাদের আয়ের বড় উৎস রেমিট্যান্স। বৈশ্বিক মহামারীর কারণে বিদেশে কর্মসংস্থান একদিকে সঙ্কুচিত হয়েছে, অন্যদিকে নতুন করে সেভাবে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। এ ছাড়াও আমাদের চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা। নির্বাচন যত এগিয়ে আসে রাজনীতি তত উত্তপ্ত হয়। রাজনৈতিক চর্চায় গাফিলতি হলে সমস্যা হয়। অনেকেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা আরেকটি চ্যালেঞ্জ। বৈশি^ক কারণে মৌলিক কয়েকটি পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যে সরকারের তরফ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পেঁয়াজের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে কমতে শুরু করেছে পেঁয়াজের দাম। চিনির আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। আমরা নিজেরাও ভোক্তা। সে বিষয়টি মাথায় রেখেই সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। সরবরাহ চেইন ঠিক রাখতে সরকার কাজ করছে বলেও জানান পরিকল্পনামন্ত্রী।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলা অতিমারীর মধ্যে দেশে অন্তত ৩০ শতাংশ কর্মক্ষম মানুষ কাজ হারিয়েছেন। একই সঙ্গে ৭০ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। আলোচ্য করোনা মহামারীর আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ শতাংশ। বর্তমানে সেটা হয়েছে ৪২ শতাংশ। অবশ্য বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। আর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, দেশের তরুণদের মধ্যে অন্তত ২৫ শতাংশই বেকার। সংস্থাটির হিসাবে মোট বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) আরেকটি জরিপ অনুসারে, মহামারীর প্রভাবে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ নতুন করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি বড় অংশও এর মধ্যে পড়েছে। তবে গত দুই বছরে দেশের অভ্যন্তরে কতসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
এদিকে গত তিন বছরে কাজের জন্য বিদেশে গেছেন প্রায় ১১ লাখ কর্মী। অথচ (২০১৯, ২০২০, ২০২১ সময়ে) টার্গেট ছিল ৩০ লাখ মানুষকে বিদেশে পাঠানোর। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে বিদেশে কর্মসংস্থান তৈরির সব হিসাব-নিকাশ ওলটপালট হয়ে গেছে। বিদেশে নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাটা এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
সরকারি-বেসরকারি পরিসংখ্যানের তথ্যমতে, প্রতিবছর কর্মক্ষমদের তালিকায় যোগ হচ্ছে প্রায় ১৮-২১ লাখ তরুণ-তরুণী। স্বাভাবিক অবস্থায় সেখান থেকে সরকারি-বেসরকারি চাকরি পায় ৬ থেকে ৮ লাখ। অর্থাৎ প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ মানুষ বেকারের তালিকায় নাম লেখান। যাদের বেশির ভাগই শিক্ষিত তরুণ। এদের বেশির ভাগই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে বের হন, কিন্তু সময়মতো কাজ পান না। ফলে দেশে বেকারের বোঝা বাড়ছে প্রতিনিয়তই। তাদের বেকারত্ব ঘোচাতে দেশের ভেতরে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে।
জানা গেছে, সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের হিসাবে তখন দেশে ৬ কোটি ৮ লাখ লোক কাজের মধ্যে ছিলেন। ২০১৩ সালে যা ছিল ৫ কোটি ৮১ লাখ। এর মানে, ওই চার বছরে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ২৭ লাখ। অর্থাৎ বছরে গড়ে পৌনে সাত লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। অথচ প্রতিবছর অন্তত ১৮-২১ লাখ মানুষ কর্মক্ষম হয়। যাদের সবারই কর্মবাজারে প্রবেশ করার কথা, কিন্তু সুযোগ না থাকায় তা হয় না।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কোভিডের কারণে দারিদ্র্য বাড়ছে। এটা তো শুধু বাংলাদেশে নয়। বিশ্বের অন্য দেশেও একই পরিস্থিতি। কোভিডের আগে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ বেশ ভালো করছিল, কিন্তু কোভিডের ধাক্কায় সে অবস্থা আর নেই। এখন মানুষের আয় কমে গেছে। বহু মানুষ নতুন করে বেকার হচ্ছে। আগের বেকার সমস্যা তো রয়েছেই। ফলে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনতে সরকারকে নানা উদ্যোগ গ্রহণের চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক এবং উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর আমাদের সময়কে বলেন, গত তিন দশকে দেশের অগ্রগতি বিশাল। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী করোনায় সেখানে বড় রকমের ধাক্কা লেগেছে। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের অর্জন বিশাল। কিন্তু করোনার অভিঘাতে দেশে দারিদ্র্য দ্বিগুণ হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ভাঙন তৈরি হয়েছে। মধ্যবিত্ত দরিদ্র হয়েছে, দরিদ্র অতিদরিদ্র হয়েছে। কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। নতুন করে কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। এখন মানুষের টিকে থাকা এবং কর্মসংস্থান তৈরি বড় চ্যালেঞ্জ। করোনা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে আমাদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের বহিরাঘাত সহ্য করার সক্ষমতা কম।
অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে যাদের থাকার কথা, তারা নেই। আবার যাদের থাকার কথা নয়, তারা আছে। সেটি দূর করতে হবে। এ ছাড়া দেশের উন্নয়নে রেমিট্যান্স বিশাল ভূমিকা রাখছে। কিন্তু করোনায় সেখানে নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এটি অব্যাহত থাকলে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া ম্যানুফ্যাকচারিং খাতকে একমুখী থেকে বহুমুখীকরণ করতে হবে। কৃষিতে উৎপাদন বাড়লেও অনেক পণ্য আমদানিনির্ভর। সেদিকে নজর দিতে হবে। এ ছাড়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ।
বৈশ্বিক করোনা ভাইরাস এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। দেশের চার বিভাগে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ভাইরাস আক্রান্ত কারও মৃত্যু হয়নি; এক বিভাগে নতুন কোনো রোগীও শনাক্ত হয়নি। স্বাস্থ্য বিভাগের এই সুখবরের মধ্যেই করোনার নতুন একটি ভ্যারিয়েন্ট শঙ্কা তৈরি করছে। এই ভ্যারিয়েন্টসহ সামনে করোনার আরেকটি ধাক্কা এলে তা যেন ঠিকমতো স্বাস্থ্য বিভাগ সামাল দিতে পারে এ জন্য নানা উদ্যোগ চলমান রাখাটাও সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষ ডা. আহমেদ পারভেজ জাবীন আমাদের সময়কে বলেন, কয়েকদিন আগে যুক্তরাজ্যে ডেল্টার একটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। সেটিকে ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। যেহেতু আমাদের দেশের অনেক মানুষের ওই দেশটির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে; তাই এই সময়ে যারা ব্রিটেন থেকে আসবে, তাদের বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এ ছাড়া ভারতে ইতোমধ্যে এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। তাই স্থলবন্দরগুলোর ওপরও বিশেষ নজর দিতে হবে যাতে কোনোভাবেই এটি আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। এ ছাড়া দেশের স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে এবং টিকাদানের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষ নজরদারির প্রয়োজন বলেও মনে করেন ডা. জাবীন। তিনি বলেন, এসবের পাশাপাশি হাসপাতালগুলোও প্রস্তুত রাখা দরকার। কারণ এই ভ্যারিয়েন্টও বেশ সংক্রমণশীল।